কামিনী রায়
গিয়াছে ভাঙিয়া সাধের বীণাটি,
ছিঁড়িয়া গিয়াছে মধুর তার,
গিয়াছে শুকায়ে সরস মুকুল ;
সকলি গিয়াছে-কি আছে আর ?
নিবিল অকালে আশার প্রদীপ,
ভেঙে-চুরে গেল বাসনা যত,
ছুটিল অকালে সুখের স্বপন,
জীবন মরণ একই মতো!
জীবন-মরণ একই মতন,-
ধরি এ জীবন কিসের তরে ?
ভগন হৃদয়ে ভগন পরান
কত কাল আর রাখিব ধরে ?
বুঝিতাম যদি কেমন সংসার,
জানিতাম যদি জীবন জ্বালা,
সাধের বীণাটি লয়ে থাকিতাম
সংসার আহ্বানে হইয়ে কালা।
সাধের বীণাটি করিয়া দোসর
যাইতাম চলি বিজন বনে,
নীরব নিস্তব্ধ কানন হৃদয়ে
থাকিতাম পড়ি আপন মনে।
আপনার মনে থাকিতাম পড়ে,
কল্পনা আরামে ঢালিয়া প্রাণ,
কে ধারিত পাপ সংসার ধার ?
সংসারের ডাকে কে দিত কান ?
না বুঝিয়া হায় পশিনু সংসারে,
ভীষণ দর্শন হেরিনু সব,
কল্পনার মম সৌন্দর্য, সংগীত
হইল শ্মশান, পিশাচরব।
হেরিনু সংসার মরীচিকাময়ী
মরুভূমি মতো রয়েছে পড়ে,
বাসনা-পিয়াসে উন্মত্ত মানব
আশার ছলনে মরিছে পুড়ে।
লক্ষ্যতারা ভূমে খসিয়া পড়িল,
আঁধারে আলোক ডুবিয়া গেল,
তমস হেরিতে ফুটিল নয়ন
ভাঙিয়ে হৃদয় শতধা হল।
সেই হৃদয়ের এই পরিণাম,
সে আশার ফল ফলিল এই!
সেই জীবনের কি কাজ জীবনে ?-
তিলমাত্র সুখ জীবনে নেই।
যাক যাক প্রাণ, নিবুক এ জ্বালা,
আয় ভাঙা বীণে আবার পাই-
যত না – যাতনা – যাতনাই সার,
নরভাগ্যে সুখ কখনো নাই।
বিষাদ, বিষাদ, সর্বত্র বিষাদ,
নরভাগ্যে সুখ লিখিত নাই,
কাঁদিবার তরে মানব জীবন,
যত দিন বাঁচি কাঁদিয়া যাই।
নাই কি রে সুখ ? নাই কি রে সুখ ?
এ ধরা কি শুধু বিষাদময় ?
যাতনে জ্বালিয়া, কাঁদিয়া মরিতে
কেবলই কি নর জনম লয় ?
কাঁদাতেই শুধু বিশ্বরচয়িতা
সৃজেন কি নরে এমন করে ?
মায়ার ছলনে উঠিতে পড়িতে
মানব জীবন অবনী ‘পরে ?
বল ছিন্ন বীণে, বল উচ্চৈস্বরে,-
না, -না, -না, মানবের তরে
আছে উচ্চ লক্ষ্য, সুখ উচ্চতর,
না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে।
কার্যক্ষেত্রে অই প্রশস্ত পড়িয়া,
সমর-অঙ্গন সংসার এই,
যাও বীরবেশে কর গিয়ে রণ ;
যে জিনিবে, সুখ লভিবে সেই।
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে ?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ,
‘সুখ’ ‘সুখ’ করি কেঁদো না আর,
যতই কাঁদিবে, যতই ভাবিবে,
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
গেছে যাক্ ভেঙে সুখের স্বপন,
স্বপন অমন ভেঙেই থাকে,
গেছে যাক্ নিবে আলোয়ার আলো,
গৃহে এস, আর ঘুরো না পাঁকে।
যাতনা যাতনা কিসেরি যাতনা ?
বিষাদ এতই কিসেরি তবে ?
যদিই বা থাকে, যখন – তখন
কি কাজ জানায়ে জগৎ ভরে ?
লুকান বিষাদ আঁধার আমায়
মৃদুভাতি স্নিগ্ধ তারার মতো
সারাটি রজনী নীরবে-নীরবে
ঢালে সুমধুর আলোক কত।
লুকান বিষাদ মানব হৃদয়ে
গভীর নৈশীথ শান্তির প্রায়,
দুরাশার ভেরী, নৈরাশ চিৎকার,
আকাঙ্ক্ষার রব ভাঙে না তায়।
বিষাদ – বিষাদ – বিষাদ বলিয়ে
কেনই কাঁদিয়ে জীবন ভরে ?
মানবের মন এত কি অসার ?
এতই সহজে নুইয়া পড়ে ?
সকলের মুখ হাসি-ভরা দেখে
পার না মুছিতে নয়ন-ধার ?
পরহিত-ব্রতে পার না রাখিতে
চাপিয়া আপন বিষাদ ভার ?
আপনার লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।